ইউক্রেন সংকট: লন্ডন সম্মেলন ও মস্কোর কৌশলগত নজর

ইউক্রেন সংকট নিয়ে লন্ডনে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক সম্মেলন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত করেছে। গত রোববার ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও জোটের নেতারা এই সম্মেলনে একত্রিত হন, যেখানে ইউক্রেনের চলমান সংকট ও তার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা হয়। তবে এই সম্মেলনের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে মস্কো। রাশিয়া কীভাবে এই আলোচনাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, তা নিয়ে চলছে গভীর বিশ্লেষণ।

সম্মেলনের প্রেক্ষাপট
ইউক্রেন সংকট গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। রাশিয়ার আগ্রাসন ও ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে প্রকাশ্য বিতর্ক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য একটি উপভোগ্য মুহূর্ত ছিল। তবে লন্ডন সম্মেলনে ইউরোপীয় নেতারা নিজেদের মধ্যে বিভক্তি কাটিয়ে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানো এবং কূটনৈতিক সংকটের মধ্যেও ইউরোপীয় ঐক্য বজায় রাখা। তবে মস্কো এই ঐক্যকে ভাঙার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে নিজের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছে।
রাশিয়ার কূটনৈতিক অবস্থান
সম্মেলনের ঠিক আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। তিনি দাবি করেন, গত ৫০০ বছরে বিশ্বে ঘটে যাওয়া বেশিরভাগ সংঘাতের উৎস ইউরোপ অথবা ইউরোপীয় নীতিই দায়ী। লাভরভ আরও যোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো সংঘাত উসকে দিতে ভূমিকা রাখেনি।
এই বক্তব্য রাশিয়ার গত কয়েক বছরের কূটনৈতিক বার্তার বিপরীত। এর আগে মস্কো বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করত এবং ইউরোপকে ওয়াশিংটনের অধীনস্ত হিসেবে চিত্রিত করত। তবে এখন রাশিয়া বুঝতে পেরেছে যে ইউরোপ একটি নাজুক অবস্থানে রয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলো একদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলা এবং ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে।
ইউরোপের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ইউরোপীয় নেতাদের জন্য এই সম্মেলন একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ইউক্রেন সংকটের সমাধান খুঁজতে গিয়ে তাদেরকে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে যদি ইউরোপ একত্রিত হতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তাহলে রাশিয়ার কৌশলগত পরিকল্পনা ব্যাহত হতে পারে।
রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেন সংকটকে নিজের শর্তে সমাপ্ত করার কৌশল হাতে নিয়েছে। কিন্তু ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ এই কৌশলকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেন সংকটের সমাধান শুধু কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব, সামরিক সংঘাত নয়।
পরিসংখ্যান ও তথ্য
- ইউক্রেন সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ১৪,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
- ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলায় প্রায় ৫০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত এক বছরে ইউক্রেনকে ২ বিলিয়ন ইউরোর আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে।
- রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে রাশিয়ার জিডিপি গত বছর ৩.৫% হ্রাস পেয়েছে।
শেষ কথা
ইউক্রেন সংকট শুধু একটি আঞ্চলিক ইস্যু নয়, এটি বৈশ্বিক রাজনীতির একটি কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। লন্ডন সম্মেলন এই সংকটের সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে, তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয়ের উপর। মস্কো এই ঐক্যকে ভাঙার চেষ্টা চালিয়ে যাবে, কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি দৃঢ়ভাবে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ সুগম হতে পারে।
এই সংকটের সমাধান শুধু ইউক্রেনের জন্যই নয়, গোটা বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য। আশা করা যায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই সংকটের অবসান ঘটাতে সক্ষম হবে।