ধর্মস্বাস্থ্য ও জীবনযাপন

শিশুদের শাসনে ইসলামের নীতিমালা: ভারসাম্যপূর্ণ তরবিয়তের দিকনির্দেশনা

ইসলামে শিশুদের শাসন ও লালন-পালনের বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা রয়েছে। এটি কেবল শাস্তি বা কঠোরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং স্নেহ, সহনশীলতা, ন্যায়বিচার এবং আদর্শ শিক্ষার সমন্বয়ে গঠিত। এই ব্লগে আমরা ইসলামে শিশুদের শাসনের নীতিমালা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে অভিভাবক ও শিক্ষকগণ সঠিক পদ্ধতিতে শিশুদের গড়ে তুলতে পারেন।


ইসলামে শিশুদের শাসনের মূলনীতি

১. নম্রতা ও সহনশীলতা

ইসলাম শিশুদের সাথে কোমল আচরণের উপর জোর দেয়। নবী মুহাম্মাদ (সা.) শিশুদের সাথে অত্যন্ত স্নেহশীল ও ধৈর্যশীল ছিলেন। তিনি তাদের সালাম দিতেন, খেলাধুলা করতেন এবং তাদের কান্না শুনে নামাজ সংক্ষিপ্ত করে দিতেন । ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন, শিশু যখন ভালো কাজ করে, তাকে প্রশংসা করা উচিত এবং ভুল করলে তা উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে সংশোধনের চেষ্টা করা উচিত ।

২. শাসনের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি

ইসলামে শাসনের একটি ধারাবাহিক পদ্ধতি রয়েছে:

  • সাত বছর বয়স পর্যন্ত: শিশুকে আদব-কায়দা ও মৌলিক ইবাদত (যেমন নামাজ) শেখানো।
  • দশ বছর বয়সে: যদি শিশু নামাজে অবহেলা করে, তবে হালকা শাস্তি (প্রহার নয়) দেওয়া যেতে পারে, তবে মুখমণ্ডলে আঘাত করা নিষিদ্ধ ।
  • কঠোর শাস্তি এড়ানো: ইসলাম শিশুদের উপর অতিরিক্ত কঠোরতা বা মারধরকে নিরুৎসাহিত করে, কারণ এটি তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ।

৩. শিক্ষা ও আদবের গুরুত্ব

শিশুদের সুশিক্ষা দেওয়া পিতামাতার উপর ফরজ। ইসলামী আইনশাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, সন্তানকে কুরআন, হাদিস ও নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া বাধ্যতামূলক । তবে শাস্তির আগে বারবার সতর্ক করা এবং ধৈর্য ধারণ করা উচিত 14।

৪. শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা

শিশুদের শাসনে ইসলামের মূল লক্ষ্য হলো সংশোধন, না যে শাস্তি। আল্লামা ইবনে খালদুন (রহ.) বলেন, অতিরিক্ত কঠোর শাস্তি শিশুদের ভীরু, মিথ্যাবাদী ও আত্মবিশ্বাসহীন করে তোলে । তাই ইসলামে শাস্তি শেষ উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

৫. সমতা ও ন্যায়বিচার

নবী (সা.) বলেছেন, “তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা কর” 13। ভাই-বোনের মধ্যে বৈষম্য করা ইসলামে নিষিদ্ধ, কারণ এটি হতাশা ও ঘৃণার জন্ম দেয়।


শিশু শাসনে ইসলামের সতর্কতাসমূহ

  • মুখে বা চোখে আঘাত করা নিষিদ্ধ: নবী (সা.) বলেছেন, “তোমরা যখন কাউকে প্রহার করো, মুখমণ্ডল থেকে বিরত থাকো” ।
  • অতিরিক্ত কঠোরতা পরিহার: শিশুর মন ভেঙে দেওয়ার মতো আচরণ ইসলাম সমর্থন করে না ।
  • শিক্ষকের দায়িত্ব: কুরআনের শিক্ষকদের অবশ্যই দয়ালু ও সহানুভূতিশীল হতে হবে, যেমন আল্লাহ নিজেকে “আর-রহমান” (পরম দয়ালু) বলে উল্লেখ করেছেন ।

ইসলামী দৃষ্টিকোণে শিশু শাসনের সেরা পদ্ধতি

  1. উপদেশ ও সতর্কতা: প্রথমে শিশুকে বুঝিয়ে বলা।
  2. ধীরে ধীরে শৃঙ্খলা আনা: যেমন নামাজের জন্য সাত বছর বয়সে নির্দেশ দেওয়া এবং দশ বছর বয়সে হালকা শাস্তির অনুমতি 2।
  3. পুরস্কার ও অনুপ্রেরণা: ভালো কাজে প্রশংসা ও পুরস্কৃত করা ।
  4. শারীরিক শাস্তি সর্বশেষ উপায়: শুধুমাত্র প্রয়োজন হলে এবং অতিরিক্ত না করে।

উপসংহার

ইসলামে শিশুদের শাসন একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি, যেখানে নম্রতা, শিক্ষা ও সংশোধনের সমন্বয় রয়েছে। কঠোরতার চেয়ে স্নেহ ও বুদ্ধিমত্তার সাথে শিশুদের গড়ে তোলাই ইসলামের লক্ষ্য। নবী (সা.)-এর জীবনী থেকে আমরা শিখতে পারি কিভাবে শিশুদের সাথে আচরণ করতে হয়, যাতে তারা সুন্দর চরিত্র ও ইমানদার ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে।

“সবচেয়ে উত্তম সম্পদ হলো একজন সচ্চরিত্র সন্তান” (হাদিস)।

আরো পড়ুনঃ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button