আজম খান: মৃত্যুর ১৩ বছর পর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত বাংলা রকের কিংবদন্তি

বাংলা রক সংগীতের পথিকৃৎ, মুক্তিযোদ্ধা এবং সংস্কৃতির অনন্য প্রতীক আজম খান মৃত্যুর সাড়ে ১৩ বছর পর পাচ্ছেন স্বাধীনতা পুরস্কার। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় এই সম্মাননা পেয়ে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। ২০২৫ সালের ৬ মার্চ সরকারি সূত্রে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। আজম খানের মতো আরও আট জনগণপ্রিয় ব্যক্তিত্বকে এবার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
আজম খান: বাংলা রকের অগ্রদূত
আজম খান শুধু একজন সংগীতশিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলা সংগীতের এক যুগের প্রতীক। তাঁর গান শুধু বিনোদনই দিত না, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তাও বহন করত। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত তাঁর ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’ বাংলা রক সংগীতকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। বিটিভিতে প্রচারিত ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ এবং ‘চার কলেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি তাঁকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। এরপর ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘হারিয়ে গেছে খুঁজে পাব না’—এমন অসংখ্য গান আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।
আজম খানের জীবন ও সংগ্রাম
আজম খানের জীবন ছিল সংগ্রাম ও সাফল্যের এক অনন্য মিশেল। ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। যুদ্ধের পর তিনি সংগীতকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন এবং বাংলা সংগীতকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন।
১৯৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম অডিও ক্যাসেট ‘এক যুগ’ বাংলা সংগীত জগতে এক নতুন ধারার সূচনা করে। আজম খানের মোট ১৭টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে, যা বাংলা রক সংগীতের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।
সংগীতের বাইরে আজম খান
সংগীতের পাশাপাশি আজম খান খেলাধুলা, অভিনয় এবং সামাজিক কাজেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন। ২০০৩ সালে ‘গডফাদার’ নামের একটি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি চলচ্চিত্রপ্রেমীদেরও মুগ্ধ করেন। এছাড়াও তিনি বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেলিং এবং সাঁতারের প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা
আজম খান তাঁর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। ২০১৯ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পান তিনি। এবার স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়ে তাঁর প্রতি রাষ্ট্রের কৃতজ্ঞতা আরও একবার প্রকাশ পেল। আজম খানের মতো একজন শিল্পী, মুক্তিযোদ্ধা এবং সংস্কৃতির ধারককে এই সম্মাননা দেওয়া শুধু তাঁর পরিবারের জন্যই নয়, গোটা দেশের জন্যই গর্বের বিষয়।
আজম খানের উত্তরাধিকার
আজম খান শুধু একজন শিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলা সংগীতের এক প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব। তাঁর গান আজও তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর সৃষ্টি এবং সংগ্রাম বাংলা সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পথ দেখিয়েছে।
শেষ কথা
আজম খানের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তি শুধু একটি পুরস্কারই নয়, এটি বাংলা সংগীত এবং সংস্কৃতির প্রতি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। তাঁর গান, তাঁর সংগ্রাম এবং তাঁর জীবনাদর্শ আজও আমাদের প্রেরণা জোগায়। আজম খান চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি এবং অবদান চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে অম্লান থাকবে।
এই ব্লগে আজম খানের জীবন, সংগ্রাম এবং সাফল্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর গান এবং অবদান বাংলা সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পথ দেখিয়েছে। আজম খানের মতো কিংবদন্তিদের সম্মাননা শুধু তাদের পরিবারের জন্যই নয়, গোটা দেশের জন্যই গর্বের বিষয়।