আন্তর্জাতিক

সিমলা চুক্তি: ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য

১৯৭২ সালের ২ জুলাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই চুক্তি শুধু একটি শান্তি চুক্তিই ছিল না, বরং এটি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু কেন এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল? এর পেছনের ইতিহাস ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কী? চলুন বিস্তারিত জানা যাক।

সিমলা চুক্তি কবে স্বাক্ষরিত হয়?

সিমলা চুক্তি ১৯৭২ সালের ২ জুলাই (আনুষ্ঠানিকভাবে রাত ১২:৪০ মিনিটে, যা কার্যত ৩ জুলাই) ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলা শহরে স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের পক্ষে প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো স্বাক্ষর করেন 2912।


সিমলা চুক্তি কেন সম্পাদিত হয়েছিল?

১. ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরিণতি

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য ভারতের হাতে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক হয় । সিমলা চুক্তি কেন স্বাক্ষরিত হয়েছিল?

এই চুক্তি স্বাক্ষরের তারিখ ১৯৭২ সালের ২ জুলাই। ওই বছরেরই ৪ অগস্ট থেকে চুক্তির শর্তাবলি কার্যকর হয়

  • পাকিস্তানের জন্য জরুরি অবস্থা: এই বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দীর মুক্তি পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ দেশটি ইতিমধ্যেই যুদ্ধে পরাজিত ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
  • ভারতের কূটনৈতিক চাপ: ভারত চেয়েছিল পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করতে ।

২. কাশ্মীর ইস্যু ও সীমান্ত স্থিতিশীলতা

১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর জম্মু-কাশ্মীরে সেনা অবস্থানের ভিত্তিতে একটি নতুন নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) নির্ধারণের প্রয়োজন দেখা দেয়। সিমলা চুক্তিতে উভয় দেশই এই রেখাকে মেনে নেয় এবং একে অপরের ভূখণ্ড দখল না করার অঙ্গীকার করে ।

৩. দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনরুদ্ধার

যুদ্ধের পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত ছিল। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে:

  • যুদ্ধবন্দী মুক্তি: ভারত ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্যকে মুক্তি দেয়, যদিও বাংলাদেশ এদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার চেয়েছিল ।
  • বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান: উভয় দেশই ভবিষ্যতে কোনো বিরোধ শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের অঙ্গীকার করে ।

৪. তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ বন্ধ

ভারত সবসময়ই চেয়েছে যে কাশ্মীর ইস্যু শুধুমাত্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনায় সমাধান হোক, কোনো আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা ছাড়াই। সিমলা চুক্তিতে এই নীতিই স্বীকৃত হয় ।

সিমলা চুক্তির বিতর্ক ও সমালোচনা

  • বাংলাদেশের অনুপস্থিতি: এই চুক্তিতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যদিও ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল ।
  • ভুট্টো-গান্ধীর কূটনৈতিক খেলা: কিছু বিশ্লেষকের মতে, ইন্দিরা গান্ধী ভুট্টোর কৌশলে পড়ে গিয়েছিলেন, কারণ লিখিতভাবে কাশ্মীর ইস্যুর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না করায় পরবর্তীতে পাকিস্তান এই বিষয়টি নিয়ে বারবার আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলেছে ।

সিমলা চুক্তির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

  • লাইন অব কন্ট্রোল (LoC) প্রতিষ্ঠা: আজও কাশ্মীরে এই রেখাই ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত নির্ধারণ করে।
  • দ্বিপক্ষীয় আলোচনার গুরুত্ব: এই চুক্তি দুই দেশকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানে উৎসাহিত করেছে, যদিও কারগিল যুদ্ধ (১৯৯৯) এর ব্যতিক্রম ছিল ।
  • ২০২৫ সালে চুক্তি স্থগিত: সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান ২০২৫ সালে সিমলা চুক্তি স্থগিত করেছে ।

উপসংহার

সিমলা চুক্তি ছিল একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, যা দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, তবুও এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। আজও এই চুক্তি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যদিও এর বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্ক থেকেই গেছে।

আপনার কী মনে হয়? সিমলা চুক্তি কি সত্যিই শান্তি আনতে পেরেছে, নাকি এটি ছিল একটি অসম্পূর্ণ সমাধান? নিচে কমেন্টে আপনার মতামত জানান!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button