ধর্ম

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব: মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

আরবি হিজরি সনের তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল। এই মাসটি মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। কারণ এই মাসেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে শুভাগমন করেছিলেন এবং এই মাসেই তিনি ইন্তেকালও করেন। বিশ্বনবী (সা.) এমন এক সময়ে পৃথিবীতে আগমন করেন যখন গোটা বিশ্ব অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। পথভ্রষ্টতা, অজ্ঞানতা এবং নৈরাজ্য ছিল সর্বত্র। ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে কাবা শরিফ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আবরাহার হস্তিবাহিনী আক্রমণ করে। কিন্তু ঐ বছর রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার পৃথিবীর ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন হয়ে উঠে। কারণ এই দিনেই জন্মগ্রহণ করেন মানবতার মুক্তিদাতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (সা.)।

জন্মের পূর্বের অলৌকিক ঘটনাবলি

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের পূর্ব থেকেই কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে, যা তার আগমনের পূর্বাভাস দেয়। পারস্যের রাজপ্রাসাদে একটি ভয়াবহ কম্পন অনুভূত হয়, যার ফলে প্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ধ্বংস হয়ে যায়। এছাড়াও, পারস্যের এক হাজার বছর ধরে জ্বলতে থাকা অগ্নিকুণ্ড নিজে থেকেই নিভে যায়। হুজুর (সা.)-এর মাতা আমিনা গর্ভাবস্থায় স্বপ্নে দেখেন যে, একজন ফেরেশতা এসে তাকে বলছেন, “তোমার গর্ভে থাকা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার নাম আহমদ রাখবে।” এই স্বপ্নের পরিপ্রেক্ষিতে মা আমিনা সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর নাম রাখেন আহমদ। তবে দাদা আব্দুল মুত্তালিব তার প্রিয় পৌত্রের নাম রাখেন মুহাম্মদ।

শৈশব ও বেড়ে ওঠা

জন্মের পর প্রথম সাত দিন আবু লাহাবের আযাদকৃত দাসী সুওয়াইবা হুজুর (সা.)-কে দুধ পান করান। এরপর আরবের প্রথা অনুযায়ী তাকে ধাত্রী হালিমা সাদিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়। হালিমা সাদিয়া হুজুর (সা.)-কে স্তন্যপান করান এবং লালন-পালন করেন। শৈশব থেকেই হযরত মুহাম্মদ (সা.) অন্যান্য শিশুদের থেকে আলাদা ছিলেন। তিনি খেলাধুলা বা অহেতুক কাজকর্ম থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। তার চরিত্রে পরিপূর্ণতা এবং নৈতিক সততা শৈশব থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে।

মানবতার মুক্তিদাতা

হযরত মুহাম্মদ (সা.) সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি শুধু একজন নবীই ছিলেন না, বরং একজন আদর্শ সংস্কারক, বিচারক, সমরনায়ক, স্বামী, পিতা এবং রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। তার জীবনের প্রতিটি দিকই মানবজাতির জন্য অনুকরণীয়। তিনি ঘরের কাজ নিজে করতেন, বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনতেন, জুতা ছিঁড়ে গেলে তা নিজেই সেলাই করতেন। তার জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে। তিনি কখনোই অহংকার বা বড়ত্ব প্রদর্শন করেননি।

সামাজিক সংস্কার ও ন্যায়বিচার

হযরত মুহাম্মদ (সা.) মানবজাতিকে এক আল্লাহর ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি শিরক থেকে দূরে থাকতে বলেছেন এবং পরোপকার, সততা ও ন্যায়বিচারের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তার আদর্শে গড়ে উঠেছিল একটি সুবিচারপূর্ণ ও মানবিক সমাজ। যেখানে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি, মমত্ববোধ এবং শান্তি ছিল মূল ভিত্তি। তার জীবদ্দশায় বিশৃঙ্খল আরব সমাজ সম্প্রীতি ও শান্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

সাহাবায়ে কেরামের ভালোবাসা

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের ভালোবাসা ছিল অতুলনীয়। তার দশ বছরের খাদেম হজরত আনাস (রা.) বলেন, “আমি দেখেছি, রাসুল (সা.)-এর চুল কাটার সময় সাহাবায়ে কেরাম তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। একটি চুল মাটিতে পড়লেই তারা তা তুলে নিতেন এবং বরকতের জন্য সংরক্ষণ করতেন।” হুজুর (সা.)-এর অধিনস্থদের প্রতি ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সদয়। হজরত আনাস (রা.) আরো বলেন, “আমি দশ বছর হুজুর (সা.)-এর খেদমত করেছি। আল্লাহর শপথ, তিনি কখনো আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হননি।”

বংশ তালিকা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশ তালিকা আজও সংরক্ষিত আছে। তার বংশধারা হলো: মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম ইবনে আব্দে মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবনে কা’ব ইবনে লুআই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর ইবনে মালিক ইবনে নযর ইবনে কিনানা ইবনে খুযাইমা ইবনে মুদরিকা ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুযার ইবনে নাযযার ইবনে মা’বাদ ইবনে আদনান।

আজকের বিশ্বে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শের প্রয়োজনীয়তা

বর্তমান বিশ্বে অশান্তি, যুদ্ধ, হানাহানি এবং নৈরাজ্য চলছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শই পারে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। তার শিক্ষা এবং জীবনাদর্শ ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি।

উপসংহার

হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তার জীবনাদর্শ, নৈতিকতা এবং মানবিক গুণাবলী আজও সমগ্র মানবজাতির জন্য পথনির্দেশক। তার আদর্শ অনুসরণ করেই আমরা একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তুলতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button